SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - রসায়ন - NCTB BOOK

টিন, লোহা, তামা, সোনা, চিনামাটির তৈরি থালাবাসন, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ হাজার হাজার প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমরা পারিবারিক জীবন, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে আসছি। এগুলো মৌলিক, যৌগিক বা বিভিন্ন মৌল ও যৌগের মিশ্রণ হতে পারে। এদের মধ্যে অনেক পদার্থ খনি থেকে পাওয়া যায়। খনিজ সম্পদ কী? কীভাবে খনি থেকে ধাতু ও অধাতু পাওয়া যায়? আবার সেগুলোকে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় বা এগুলো থেকে কীভাবে অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করা যায় সেগুলো নিয়েই এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।

 

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
 

  • খনিজ সম্পদের ধারণা দিতে পারব।
  • শিলা, খনিজ ও আকরিকের মধ্যে তুলনা করতে পারব।
  • ধাতুসমূহের নিষ্কাশনের উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করতে পারব।
  • ধাতুসংকর তৈরির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • সালফারের উৎস এবং এদের কতিপয় প্রয়োজনীয় যৌগ প্রস্তুতের বিক্রিয়া, রাসায়নিক ধর্মের বর্ণনা এবং গৃহে, শিল্পে ও কৃষিক্ষেত্রে তা ব্যবহারের পুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • খনিজ দ্রব্যের সসীমতা, যথাযথ ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • খনিজ দ্রব্যের ব্যবহারে সতর্কতা এবং সংরক্ষণে আগ্রহ প্রদর্শন করতে পারব।
Content added By

খনিজ সম্পদ:  আমাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধাতু, অধাতু, উপধাতু বা তাদের বিভিন্ন যৌগ প্রকৃতিতে মাটি, পানি কিংবা বায়ুমণ্ডল থেকে সংগ্রহ করা হয়। মাটি, পানি বা বায়ুমণ্ডলের যে অংশ থেকে এগুলোকে সংগ্রহ করা হয় তাকে খনিজ বলে। খনিজ কঠিন হতে পারে, যেমন—লোহা বা তামার খনিজ। তরল হতে পারে, যেমন—পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেলের খনিজ, আবার গ্যাসীয় হতে পারে যেমন—প্রকৃতিক গ্যাসের খনিজ।
 

আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায় যা রান্নার কাজে, যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বা বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পেট্রোলিয়ামের খনিজ রয়েছে, যা তারা সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করছে এবং সমস্ত পৃথিবীর খনিজ তেলের চাহিদা পূরণ করছে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে রয়েছে সোনা ও হীরার খনিজ। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পাওয়া যার, যা দেশ তথা সমগ্র পৃথিবীর উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। তাই কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় এ খনিজগুলোকে একত্রে খনিজ সম্পদ বলা হয়।

 

শিলা ( Rocks)
বিভিন্ন খনিজ পদার্থ মিশ্রিত হয়ে কিছু শন্তু কণা তৈরি হয়, ঐ শক্ত কণাসমূহ একত্র হয়ে যে পদার্থ তৈরি হয় তাকে শিলা বলে। এ সকল শিলা যেভাবে তৈরি হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে শিলা সাধারণত তিন প্রকার: (i) আয়ের শিলা, (ii) পাললিক শিলা ও (iii) রূপান্তরিত শিলা 

 

আগ্নেয় শিলা(Igneous Rock) 

আগ্নেয়গিরি থেকে যে গলিত পদার্থসমূহের মিশ্রণ বের হয় তাকে ম্যাগমা বলে। ম্যাগমা যখন ঠাণ্ডা হয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হয় তখন তাকে আগ্নেয় শিলা বলে। যেমন— গ্রানাইট। আগ্নেয় শিলা থেকে অনেক মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায়।

 

পাললিক শিলা (Sedimentary Rock) 

আবহাওয়া ও জলবায়ু ইত্যাদি পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির পানি, বাতাস, কুয়াশা, ঝড় ইত্যাদির কারণে মাটির উপরিভাগের ভূ-ত্বকের কাদামাটি, বালিমাটি ইত্যাদি ধুয়ে কোনো কোনো জায়গার পলি আকারে জমা হয় তারপরে পলির মধ্যে জমে থাকা কণাগুলো বিভিন্ন স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে যে শিলা তৈরি হয় তাকে পাললিক শিলা বলে। যেমন— বেলেপাথর। রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rock) আগের শিলা, পাললিক শিলা বিভিন্ন তাপ ও চাপে পরিবর্তিত হয়ে নতুন ধরনের যে শিল তৈরি হয় সেগুলোকে রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমন: করলা । মাটির নিচে শিলার বিভিন্ন স্তর সৃষ্টির প্রক্রিয়া। মাটির নিচে শিলা বিভিন্ন স্তরে সজ্জিত থাকে। মাধ্যাকর্ষণ বল, তাপ, চাপ এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে মাটির নিচে শিলা বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি করে।

 

খনিজ ও আকরিক
খনিজ (Minerals): মাটির উপরিভাগে বা মাটির তলদেশে যে সকল পদার্থ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন—বিভিন্ন প্রকার ধাতু বা অধাতু ইত্যাদি সংগ্রহ করে থাকি তাদেরকে খনিজ বলা হয়। যে অঞ্চল থেকে খনিজ উত্তোলন করা হয় তাকে খনি বলে ।
 

আকরিক (Ores)
যে সকল খনিজ থেকে লাভজনকভাবে ধাতু বা অধাতুকে সংগ্রহ বা নিষ্কাশন করা যায় সে সকল খনিজকে আকরিক বলে৷ যেমন— গ্যালেনা (Pbs) থেকে লাভজনকভাবে লেড ধাতু নিষ্কাশন করা যায়, তাই গ্যালেনাকে লেড ধাতুর আকরিক বা লেড ধাতুর খনিজ বলা হয়৷ বক্সাইট থেকে লাভজনকভাবে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশন করা যায়। অতএব বক্সাইটকে অ্যালুমিনিয়ামের আকরিক বা খনিজ বলা হয়। আবার, কাদামাটি থেকে লাভজনকভাবে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশন করা যায় না, সেজন্য কাদামাটি শুধু অ্যালুমিনিয়ামের খনিজ কিন্তু আকরিক নয়। অতএব, আমরা বলতে পারি আকরিক হলে সেটা অবশ্যই খনিজ হবে কিন্তু খনিজ হলে সেটা আকরিক নাও হতে পারে। আয়রনের সালফাইডকে আয়রন পাইরাইটস (FeS2 ) বলা হয়। আয়রন পাইরাইটস থেকে আয়রন ধাতু নিষ্কাশন করা যায় ।
 

খনিজ সম্পদের অবস্থান
আগে মনে করা হতো যে শুধু ভূগর্ভে বা মাটির নিচেই বুঝি খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। এখন আর এ ধারণা সঠিক বলা যায় না। কোনো কোনো খনিজ ভূগর্ভে আবার কোনো কোনো খনিজ ভূপৃষ্ঠে পাওয়া যায়। সালফার খনিজ ভূগর্ভে পাওয়া যায়। নেত্রকোনার বিজয়পুরে সাদা মাটি বা কেউলিন খনিজ ভূপৃষ্ঠেই পাওয়া যায়৷ কক্সবাজারের সমুদ্রের বালিতে জিরকোনিয়ামের খনিজ জিরকন, আবার লোহার খনিজ হেমাটাইট, অ্যালুমিনিয়ামের খনিজ বক্সাইট এগুলো অনেক জায়গাতে ভূপৃষ্ঠেই পাওয়া যায়। হ্যালোজেনসমূহের খনিজ সমুদ্রের পানিতে পাওয়া যায়।

 

Content added By

যে পদ্ধতিতে আকরিক থেকে ধাতু সংগ্রহ করা হয় তাকে ধাতু নিষ্কাশন বলে। বিভিন্ন ধাতুর ধর্মও বিভিন্ন। সে কারণে সকল ধাতুকে পৃথক করতে নির্দিষ্ট কোনো একটি প্রক্রিয়া নেই। তাই বিভিন্ন ধাতুর নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা থাকে। কিছু কিছু অসক্রিয় ধাতু যেমন— সোনা, প্লাটিনাম এগুলোকে কখনো কখনো বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু কম বা অধিক সক্রির ধাতুসমূহ সাধারণত যৌগ হিসেবে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় যেমন, ধাতুসমূহের অক্সাইড, সালফাইড, নাইট্রেট, কার্বনেট ও অন্যান্য অনেক প্রকার যৌগ হিসেবে। তাই সক্রিয় ধাতুসমূহের যৌগগুলোকে বিজারিত করে বা তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের যৌগ থেকে পৃথক করা হয়। ধাতু আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো হলো (i) আকরিককে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা (ii) আকরিক এর ঘনীকরণ (iii) অনীকৃত আকরিককে অক্সাইডে রূপান্তর (iv) ধাতব অক্সাইডকে মুগ্ধ ধাতুতে রূপান্তর (v) ধাতু বিশুদ্ধিকরণ। তবে একটি নির্দিষ্ট ধাতুর জন্য সব সময় সবগুলো ধাপ প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেকটি ধাতুর ধর্মের উপর ভিত্তি করেই সেই ধাতুর জন্য প্রযোজ্য ধাপগুলো ব্যবহার করতে হবে। নিচে বিভিন্ন ধাপ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
 

(i) আকরিককে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা 

সাধারণত খনি থেকে যে আকরিককে উত্তোলন করা হয় তা যদি বড় এবং কঠিন শিলাখণ্ড হয় তবে এই কঠিন শিলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়। প্রথমে শিলাখন্ডকে জো ক্রাশারের সাহায্যে ছোট ছোট টুকরায় পরিণত করা হয় এবং তারপর বল ক্রাশারের সাহায্যে আকরিকের ছোট ছোট টুকরাকে মিহি দানায় বা পাউডারে পরিণত করা হয়।
 

(11) আকরিক এর ঘনীকরণ
সাধারণত যে আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হবে সেই আকরিক ব্যতীত অন্যান্য কিছু পদার্থ আকরিকের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। আকরিকের সাথে মিশ্রিত থাকা এসব পদার্থকে অপদ্রব্য বা এনিমল বলে। কাজেই আকরিককে যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাউডারের দানায় পরিণত করা হয় তখনো সেই পাউডার দানার মধ্যে বিভিন্ন অপদ্রব্য বা খনিজমল থাকে। যেমন—বক্সাইট আকরিককে খনি থেকে তোলার সময় বক্সাইট আকরিকের সাথে খনিজমল হিসেবে বালি মিশ্রিত থাকে। এই খনিজমলসমূহকে দূর করে বিশুদ্ধ আকরিক পাওয়ার জন্য যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় তাকে আকরিকের ঘনীকরণ বলা হয়। আকরিকের  ঘনীকরণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন: হাইড্রোলাইটিক পদ্ধতি, চৌম্বকীয় পৃথকীকরণ, ফেনা ভাসমান পদ্ধতি, রাসায়নিক পদ্ধতি ইত্যাদি। 

 

হাইড্রোলাইটিক পদ্ধতি(Hydrolytic Method)
 

এ পদ্ধতিটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় অক্সাইড আকরিকের ক্ষেত্রে। অক্সাইড আকরিকের কণাগুলো ভারী হয়। আর এতে থাকা অপদ্রব্যগুলো কিন্তু তুলনামূলক হালকা হয়। এই পদ্ধতিতে ১টি কম্পমান হেলানো খাঁজকাটা টেবিলের মধ্যে আকরিককে ঢালা হয়, এই আকরিকের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত করা হয়। এতে ভারী আকরিক ঘনীভূত হয়ে খাঁজের মধ্যে পড়ে থাকে এবং হালকা খনিজমলসমূহ পানির প্রবাহে ধৌত হয়ে চলে যায়। এভাবে আকরিক থেকে খনিজমলসমূহ চলে যাবার পর আকরিক গাঢ় হয়।
 

ফেনা ভাসমান পদ্ধতি (Proth Floatation Method) 

এ পদ্ধতিতে সালফাইড আকরিকগুলোকে ঘনীকরণ করা হয়। একটি বড় ট্যাংকে আকরিক নিম্নে এর মধ্যে পানি দেওয়া হয়, তারপর এর মধ্যে অল্প অল্প করে তেল যোগ করা হয়। এরপর এই মিশ্রণের মধ্যে বায়ুপ্রবাহ চালনা করলে সালফাইড আকরিকগুলো তেলে দ্রবীভূত হয় এবং ফেনার আকারে ভেসে উঠে। ফেনাসহ আকরিক পৃথক করে নেওয়া হয় এবং খনিজমল পাত্রের তলায় পড়ে থাকে।
 

তেল ফেনা ভাসমান প্রণালির পরীক্ষা
 

উপকরণ: বালি, কেরোসিন, স্পেচুলা, তরল/গুঁড়া সাবান, ওয়াচ গ্লাস, ছিপিসহ একটি বড় টেস্টটিউব, চেলকোপাইরাইট, গ্যালেনা বা হেমাটাইট আকরিক গুঁড়ো
2. টেস্টটিউবের মুখে ছিপি লাগিরে ঝাঁকাও। বালি এবং খনিজ কি পৃথক হয়েছে?
3. টেস্টটিউবে একটু তরল/গুঁড়া সাবান এবং কয়েক ফোঁটা কেরোসিন যোগ করো।
4. টেস্টটিউবের মুখে ছিপি লাগিয়ে পুনরার ভালো করে ঝাঁকাও।

5. স্পেচুলা দিয়ে কিছুটা ফেনা ওয়াচ প্লাসে নিয়ে পরীক্ষা কর এতে খনিজ আছে কি না? 6. বালি তলানিতে পড়ে থাকে কিন্তু খনিজ টেস্টটিউবের উপরের অংশে ভাসমান থাকে।
 

চৌম্বকীয় পৃথকীকরণ পদ্ধতি
যখন খনিজমল বা আকরিক এদের মধ্যে যেকোনো একটি চুম্বক দ্বারা আকর্ষিত হয় তখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে চূর্ণীকৃত আকরিককে একটি ঘূর্ণায়মান বেল্টের উপর দিয়ে চালনা করা হয়। বেল্টটি চিত্রের মতো দুইটি ধাতব ঢাকার সাহায্যে ঘোরে। এই ধাতব ঢাকা দুইটির একটি চৌম্বক ধর্ম বিশিষ্টি। এই চুম্বক দ্বারা আকর্ষিত হয়ে খনিজমলযুক্ত আকরিকের চৌম্বক অংশটি চুম্বক ধর্ম বিশিষ্ট চাকার নিচে এবং কাছে স্তূপ আকারে জমা হয়। অন্যদিকে অচৌম্বক অংশটি একটু দূরে চিত্রের মতো জমা হয়। ফলে আকরিক খনিজমল থেকে পৃথক হয়ে যায়। ক্রোমাইট FeO.Cr2O3, ব্লুটাইল TiO2 এর মতো চৌম্বকধর্ম বিশিষ্ট আকরিক থেকে খনিজমল অপসারণ করার জন্য চুম্বকীয় পৃথকীকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

রাসায়নিক পদ্ধতি
যে সকল ক্ষেত্রে কোনো পদার্থ আকরিক বা খনিজমলের যেকোনো একটির সাথে বিক্রিয়া করে কিন্তু অন্যটির সাথে বিক্রিয়া করে না সে সকল ক্ষেত্রে আকরিক থেকে খনিজমল অপসারণ করার জন্য রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন: বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড পাবার জন্য রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বক্সাইটের সাথে আয়রন অক্সাইড, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, বালি ইত্যাদি খনিজমল মিশ্রিত থাকে। বক্সাইটের মধ্যে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH ) যোগ করে উত্তপ্ত করলে বক্সাইটের (Al2O3.2H2O) সাথে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) বিক্রিয়া করে সোডিয়াম অ্যালুমিনেট (NaAlo) ও পানি তৈরি হয়।
 

Al2O3.2H2O+ 2NaOH    →          2NaAlO₂+ 3H,0
 

পরম সোডিয়াম অ্যালুমিনেটকে পানির সাথে বিক্রিয়া করালে অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড এবং সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড উৎপন্ন হয়। সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড পানিতে দ্রবীভূত থাকে এবং অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড পাত্রের নিচে তলানি আকারে অধঃক্ষিত হয়।
 

NaAlO₂ + 2H₂O             →         Al(OH)3 + NaOH
 

অ্যালুমনিরাম হাইড্রোক্সাইডকে পৃথক করে এনে তাকে 1100°C তাপমাত্রার উত্তপ্ত করলে বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং পানি উৎপন্ন হয়।

 

(iii) ঘনীকৃত আকরিককে অক্সাইডে রূপান্তর 

ঘনীকৃত আকরিককে ভষ্মীকরণ বা তাপজারণ পদ্ধতিতে ধাতুর অক্সাইডে পরিণত করা হয়। আকরিকের ভষ্মীকরণ (Calcination of Ores ) আকরিকে উপস্থিত ধাতুকে বিজারিত করে পৃথক করার আগে ঘনীকৃত আকরিককে গলনাঙ্কের চেয়ে কম তাপমাত্রায় বাতাসের অনুপস্থিতিতে উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে ভষ্মীকরণ বলে। ভষ্মীকরণের ফলে আকরিক থেকে পানিসহ কার্বনেট, বাইকার্বনেট, হাইড্রোক্সাইড জাতীয় কিছু অপদ্রব্য কার্বন ডাই-অক্সাইড কিংবা পানি হিসেবে দূরীভূত হয়। এ সকল অপদ্রব্য দূর না করলে পরবর্তীতে এগুলো দূর করা কঠিন।

আকরিকের তাপজারণ
সাধারণত সালফাইড আকরিকের তাপজারণ করা হয়। সালফাইড আকরিককে গলনাঙ্কের চেয়ে কম তাপমাত্রায় বাতাসের উপস্থিতিতে উত্তপ্ত করা হয়৷ এর ফলে সালফাইড, ফসফরাস, আর্সেনিক ইত্যাদি উদ্বায়ী খনিজমল অক্সাইড হিসেবে দূরীভূত হয়।

(iv) ধাতব অক্সাইডকে মুক্ত ধাতুতে রূপান্তর
আকরিককে ভষ্মীকরণ বা তাপজারণ করায় যে ধাতব অক্সাইড পাওয়া যায় তাদেরকে বিজারিত করলে ধাতু পাওয়া যায়। বিভিন্নভাবে এ বিজারণ সম্পন্ন করা যায় যেমন, তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজারণ, কার্বন বিজারণ পদ্ধতি, স্ববিজারণ ইত্যাদি। ধাতুর সক্রিয়তা সিরিজে তাদের অবস্থানের উপর কোন পদ্ধতিতে বিজারণ সম্পন্ন করা হবে তা নির্ভর করে। তোমরা যেন সহজে সেটা বুঝতে পারো তার জন্য নিচের ছকটি দেওয়া হলো।

তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজারণ (Reduction by Electrolysis): সক্রিয়তা সিরিজে প্রদর্শিত উপরের দিকে অবস্থিত অধিক সক্রিয় ধাতু K, Na, Ca Mg Al ইত্যাদি ধাতুসমূহের জন্য তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজারণ সম্পন্ন করা হয়। নিচে অ্যালুমিনিয়ামের অক্সাইড থেকে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।
এই পদ্ধতিতে প্রথমে কঠিন অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডকে গলিয়ে তরল করতে হবে। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড 2050°C তাপমাত্রায় গলে যায়৷ এত বেশি তাপমাত্রা তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যদি অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এর মধ্যে ক্রায়োলাইট (Na3AlF6) যোগ করা হয়, তাহলে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড 800°C-1000°C তাপমাত্রায় গলে যায়। গলিত Al2O3 এর মধ্যে Al3+ এবং O2- আয়ন থাকে।
 

A1203              2A13+ + 302-
 

গ্রাফাইট কার্বন এর আস্তরণযুক্ত একটি স্টিলের পাত্রের মধ্যে গলিত অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং ক্রায়োলাইট এর মিশ্রণ নেওয়া হয় এবং এর মধ্যে কয়েকটি কার্বন দণ্ড এমনভাবে প্রবেশ করানো হয় যাতে এটি স্টিলের পাত্রকে স্পর্শ না করে। এবার স্টিলের পাত্রকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে এবং কার্বন দণ্ডগুলোকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। বিদ্যুৎ প্রবাহের সাথে সাথে তড়িৎ বিশ্লেষণ শুরু হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণকালে O2 - অ্যানোডে ইলেকট্রন ত্যাগ করে O2 গ্যাস তৈরি করে এবং দ্রবণে বিদ্যমান Al3+ ক্যাথোড থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে Al ধাতুতে পরিণত হয়।

 

কার্বন বিজ্ঞারণ পদ্ধতি (Method of Carbon Reduction )
ধাতব অক্সাইড এর সাথে কার্বনকে উত্তপ্ত করে ধাতু নিষ্কাশন করা হয়। যেমন: ZnO থেকে 2n ধাতু, FeO থেকে Fe ধাতু, PbO থেকে Pb ধাতু কিংবা CuO থেকে Cu ধাতুকে এই পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কার্বন বিজারণ পদ্ধতি। সক্রিয়তা সিরিজে প্রদর্শিত মধ্যম মানের সক্রিয় ধাতুসমূহকে এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞারণ ঘটানো হয়।

স্ববিজারন (Auto Reduction): সক্রিয়তা সিরিজে অবস্থিত নিচের দিকে অবস্থিত কম সক্রিয় ধাতু Cu, Hg Ag ধাতুসমূহের অক্সাইড এর ক্ষেত্রে কোনো বিজারক যোগ না করে শুধু উত্তপ্ত করেও বিজারণ ঘটানো হয়। উদাহরণ হিসেবে মার্কারির আকরিককে এভাবে বিজারিত করা যায়:

HgS + O2            Hg (1) + SO2

 

(v) ধাতু বিশুদ্ধিকরণ
উপরে উল্লেখিত বিজারণ পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমে প্রাপ্ত ধাতুসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হয় না। এতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপদ্রব্য থেকে যায়। এ অপদ্রব্য দূর করতে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
 

বিগালক যোগ করার পদ্ধতি: উচ্চ তাপমাত্রায় কার্বন বিজারণ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ধাতুর মধ্যে কিছু খনিজমল দ্রবীভূত থাকতে পারে। এই খনিজমল অপসারণ করার জন্য যে পদার্থ যোগ করা হয় তাকে বিগালক বলে। খনিজমল ক্ষারকীয় হলে এসিডিক বিগালক (SiO2) যোগ করা হয় এবং খনিজমল এসিডিক হলে তার মধ্যে ক্ষারকীয় বিগালক (CaO) যোগ করা হয়। বিগালক এবং খনিজমল একত্র হয়ে ধাতুর মল বা ধাতুমল তৈরি হয়। ধাতুর মল গলিত ধাতুতে দ্রবীভূত হয় না বলে উপর থেকে ধাতুমলকে গলিত ধাতু থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। বিগলন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত ধাতু বিশুদ্ধ নয়। এই অবিশুদ্ধ ধাতুকে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাতু বিশুদ্ধ করা হয়। নিচে ধাতু বিশুদ্ধকরণের জন্য তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।
 

তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ধাতুর বিশোধন: তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ধাতুর বিশোধনে অবিশুদ্ধ ধাতুকে অ্যানোড এবং বিশুদ্ধ ধাতুর একটি পাতকে ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষ্য হিসেবে যে ধাতুকে বিশুদ্ধ করতে হবে তার লবণের দ্রবণকে ব্যবহার করা হয়। যখন তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয় তখন অ্যানোড থেকে ধাতুর পরমাণু ইলেকট্রন ত্যাগ করে আয়ন হিসেবে দ্রবণে প্রবেশ করে। অপরদিকে, ধাতব আয়ন ইলেকট্রন গ্রহণ করে বিশুদ্ধ ধাতু হিসেবে ধাতপাতে জমা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কপার ধাতু ও অন্যান্য ধাতু বিশোধন করা হয়। নিচে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কপার ধাতুর বিশুদ্ধকরণ বর্ণনা করা হলো।
 

তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে কপার ধাতুর বিশুদ্ধকরণ: বিজারণ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত কপার ধাতু 98% বিশুদ্ধ। একে তড়িৎ বিশোধন পদ্ধতি প্রয়োগ করে 99.9% বিশুদ্ধ কপার ধাতু তৈরি করা যায়৷ এক্ষেত্রে CuSO4 এর জলীয় দ্রবণ একটি পাত্রে নেওয়া হয়। এই পাত্রে যে ধাতবদণ্ডকে বিশুদ্ধ করতে হবে সেই অবিশুদ্ধ কপারদণ্ডকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। এটি অ্যানোড হিসেবে কাজ করে। একটি বিশুদ্ধ কপার দণ্ডকে ঐ ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। এটি ক্যাথোড হিসেবে কাজ করে। সাধারণত, অবিশুদ্ধ কপার দণ্ড মোটা থাকে এবং বিশুদ্ধ কপার দত্ত পাতলা থাকে।
 

এবার ব্যাটারির সাহায্যে দ্রবণের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহিত করলে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহৃত অবিশুদ্ধ কপার দণ্ড থেকে Cu2+ আয়ন হিসেবে দ্রবণে চলে যায় এবং দ্রবণ থেকে Cu2. বিশুদ্ধ কপার দণ্ডে জমা হয়। এক্ষেত্রে অ্যালোভের জারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং ক্যাথোডের বিজারণ বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।


 

Content added By

কতোগুলো ধাতুকে একত্রে গলানোর পর গলিত মিশ্রণকে ঠাণ্ডা করলে যে ধাতু মিশ্রণ পাওয়া যায় তাকে সংকর ধাতু বলা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব 5000 থেকে খ্রিষ্টপূর্ব 3000 পর্যন্ত সময়কালকে তাম্রযুগ বলা হয়। কারণ এই সময়ে তামা দিয়ে মানুষ গয়না, অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি তৈরি করত। কিন্তু তামা নরম ধাতু বিধায় এই ধাতু দিয়ে যে অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি তৈরি করা হতো তা বেশি দিন কার্যকর থাকত না। সেজন্য সেই প্রাচীনকালেই মানুষ গলিত কপারের সাথে গলিত টিন মিশিয়ে মিশ্রণকে ঠাণ্ডা করে ব্রোঞ্জ তৈরি করেছিল। ব্রোঞ্জ মূলত একটি সংকর ধাতু। কোনো গরম গলিত ধাতুর মধ্যে অন্য কোনো গরম গলিত ধাতু বা অধাতু মিশিয়ে সেই মিশ্রণকে ঠাণ্ডা করলে যে কঠিন পদার্থ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় সংকর ধাতু। প্রাচীনকালের মানুষদের সংকর ধাতু ব্রোঞ্জ আবিস্কার ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। খ্রিষ্টপূর্ব 3000 থেকে 1000 পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় ব্রোঞ্জ যুগ। এই সময় ব্রোঞ্জ দ্বারা বিভিন্ন অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি তৈরি করা হতো। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করতে ধাতুর চেয়ে সংকর ধাতু বেশি উপযোগী। লোহা এবং কার্বন মিশিয়ে স্টিল নামক সংকর ধাতু তৈরি করা হয়। ছুরি, কাঁচি, রেলের চাকা, রেললাইন, জাহাজ, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি স্টিল দ্বারা তৈরি করা হয়। আবার গরম গলিত লোহার মধ্যে গলিত কার্বন, নিকেল ও ক্রোমিয়াম মিশিয়ে যে সংকর ধাতু তৈরি হয় তাকে স্টেইনলেস স্টিল বলে। হাসপাতালে ডাক্তাররা যে ছুরি বা কাঁচি ব্যবহার করে তা স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। গলিত কপার এবং গলিত জিংক একত্রে মিশিয়ে পিতল নামক সংকর ধাতু তৈরি হয়। বৈদ্যুতিক সুইচ, পাতিল ইত্যাদি তৈরিতে পিতল ব্যবহৃত হয়। কপার ও টিন মিশিয়ে সংকর কাঁসা বা ব্রোঞ্জ তৈরি হয়। থালাবাসন, গ্লাস ইত্যাদি তৈরিতে ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হয়। অ্যালুমিনিয়াম, কপার,ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও লোহার মিশ্রণে ডুরালমিন নামক সংকর ধাতু তৈরি করা হয়। এটি উড়োজাহাজের বডি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।

তোমরা এতক্ষণ জানলে বিভিন্ন ধাতু একত্রে মিশিয়ে সংকর ধাতু তৈরি করা হয়৷ এই সংকর ধাতু তৈরিতে সকল ধাতুকে সমান পরিমাণে মেশানো হয় না। সংকর ধাতুর মধ্যে একটি থাকে প্রধান ধাতু এবং অন্য এক বা একাধিক পদার্থ থাকে অপ্রধান ধাতু বা অধাতু। যেমন—পিতলের মধ্যে প্রধান ধাতু কপার থাকে 65% এবং জিংক 35% থাকে। প্রধান ধাতুর নাম অনুসারে সংকর ধাতুর নামকরণ করা হয়। যেমন: স্টিলের মধ্যে লোহা প্রধান ধাতু এবং কার্বন অপ্রধান অধাতু। স্টিলে লোহা থাকে 99% এবং কার্বন থাকে 1% এজন্য স্টিলকে লোহার সংকর ধাতু বলা হয়। অনুরূপভাবে, কাঁসার মধ্যে প্রধান ধাতু কপার থাকে 90%, টিন থাকে 10% । এজন্য কাঁসা কপারের সংকর ধাতু। আবার, পিতলে প্রধান ধাতু কপার থাকে 65% এবং অপ্রধান ধাতু জিংক থাকে 35%। এজন্য পিতলও কপারের সংকর ধাতু। কপারের দুইটি সংকর ধাতু আছে, যথা: পিতল (ব্রাস) ও কাঁসা (ব্রোঞ্জ)।

Content added By

লোহা বা লোহার সংকর ধাতুর তৈরি জিনিসপত্র জানালার গ্রিল, আলমিরা ইত্যাদি খোলা জায়গা বা বাতাসে দীর্ঘদিন থাকলে এসব জিনিসপত্রের উপর লালচে বাদামি বর্ণের এক ধরনের পদার্থ তৈরি হয়। এই বাদামি পদার্থকে লোহার মরিচা বলা হয়। মরিচা তৈরির মাধ্যমে লোহা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিশুদ্ধ কপার বা পিতল বা কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র দীর্ঘদিন বাতাসে থাকার ফলে এদের উপর কালো বা বাদামি বা সবুজ বর্ণের একটি আস্তরণ পড়ে। এই আস্তরণকে কপারের তাম্রমল বলা হয়। তাম্রমল তৈরির মাধ্যমে তামা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
 

সাধারণত বিশুদ্ধ ধাতু বা সংকর ধাতু দীর্ঘদিন বাতাসে থাকার ফলে ধাতু বা সংকর ধাতুর উপর ভিন্ন বর্ণযুক্ত একটি নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াকে ধাতুর ক্ষয় বলে।
 

লোহা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যে লালচে বাদামি বর্ণের মরিচা তৈরি হয় সেটি হলো আর্দ্র ফেরিক অক্সাইড (Fe2O3.nH2O)। আবার বিভিন্ন বর্ণের তাম্রমলে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ উপস্থিত থাকে। যেমন—কোনো কোনো তাম্রমলে কিউপ্রাস অক্সাইড (Cu2O) উপস্থিত থাকে। কোনো কোনো তাম্রমলে কিউপ্রাস সালফাইড বা চালকোসাইট (Cu2S) উপস্থিত থাকে। তাম্রমলকে কোনো নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংকেতে প্রকাশ করা যায় না। কারণ তাম্রমলের সব জায়গায় একই ধরনের পদার্থ তৈরি হয় না। সাধারণত কোনো কোনো ধাতু বা সংকর ধাতু যখন বায়ুমণ্ডলে থাকে তখন ধাতুসমূহ ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয়। এখানে একটি জারণ বিক্রিয়া হয়। আবার, ধাতু যে ইলেকট্রন ত্যাগ করে বায়ুমণ্ডলের কোনো উপাদান সেই ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়। এখানে একটি বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। অতঃপর ধনাত্মক আয়ন এবং ঋণাত্মক আয়নের মধ্যে বিক্রিয়ায় একটি যৌগ তৈরি হয়। নতুন যৌগটি রুপান্তরিত হয়ে বা অন্যান্য যৌগের সাথে বিক্রিয়া করে। এভাবে ধাতু বা সংকর ধাতু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

লোহার উপর মরিচা পড়ার বিক্রিয়া অনেক ধীরে সংঘটিত হয় এবং অনেকগুলো ধাপে সংঘটিত হয়। এ সকল ধাপসমূহের মধ্যে একটি ধাপে জারণ বিক্রিয়া এবং একটি ধাপে বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়৷ এজন্য লোহায় মরিচা পড়ার বিক্রিয়াটি জারণ বিজারণ বিক্রিয়া। লোহার মরিচা পড়ার জন্য বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন (O2) এবং পানির (H2O) প্রয়োজন হয়। বায়ুমণ্ডলের পানি কিছুটা বিয়োজিত হয়ে H+ ও OH- তৈরি করে।

 

ধাতু ক্ষয়রোধের উপায়
ধাতু বা সংকর ধাতু যদি বাতাসের অক্সিজেন এবং পানির সংস্পর্শে না আসে তবে ধাতু ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। এটি বিভিন্নভাবে করা যায়, যেমন (i) রং করে (ii) ইলেকট্রোপ্লেটিং ও (iii) গ্যালভানাইজিং করে ইত্যাদি। তোমরা বাড়িতে লোহার তৈরি দরজা-জানালা রং কর যেন লোহা বাতাসের অক্সিজেন এবং পানির সংস্পর্শে না আসে। আমরা জানি কম সক্রিয় ধাতু সাধারণত বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে না। কিন্তু বেশি সক্রিয় ধাতু বাতাসের অক্সিজেন এবং পানির সাথে দ্রুত বিক্রিয়া করে। অতএব, বেশি সক্রিয় ধাতুর ক্ষয় হওয়া থেকে ধাতুকে রক্ষা করার জন্য বেশি সক্রিয় ধাতুর উপর কম সক্রিয় ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। এভাবে বেশি সক্রিয় ধাতুকে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। একটি অধিক সক্রিয় ধাতুর উপর কম সক্রিয় ধাতুর প্রলেপ দুইভাবে দেওয়া যার যথা— ইলেকট্রোপ্লেটিং ও গ্যালভানাইজিং।

ইলেকট্রোপ্লেটিং (Electroplating)
সাধারণত তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে একটি ধাতুর উপর আরেকটি ধাতুর প্রলেপ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইলেকট্রোপ্লেটিং। এক্ষেত্রে যে ধাতুর প্রলেপ দিতে হবে তাকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। যে ধাতুর উপর প্রলেপ দিতে হবে তাকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়৷ এরপর তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে ইলেকট্রোপ্লেটিং করা হয়। যেমন— লোহার উপর কপার ধাতুর প্রলেপ দেওয়ার জন্য CuSO4 এর একটি দ্রবণ নেওয়া হয় এবং কপার দণ্ডকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে এবং লোহা দণ্ডকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করে দ্রবণে তড়িৎ প্রবাহিত করা হয়। তড়িৎ প্রবাহকালে Cu দণ্ডের কপার 2টি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Cu2+ হিসেবে দ্রবণে চলে যায়

Cu        Cu2+ + 2e- [জারণ বিক্রিয়া]
 

এবার এই Cu2+ দ্রবণের মধ্য দিয়ে Fe দণ্ড থেকে 2টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে Cu এ পরিণত হয় এবং Fe দণ্ডের উপর লেগে যায়।
 

Cu2+ + 2e-      Cu [বিজারণ বিক্রিয়া]
 

গ্যালভানাইজিং (Galvanizing): যেকোনো ধাতুর উপর জিংকের প্রলেপ দেওয়াকে গ্যালভানাইজিং বলে। এক্ষেত্রে তড়িৎ বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। কোনো ধাতুর উপর যেকোনোভাবে জিংকের প্রলেপ দিয়ে গ্যালভানাইজিং করা হয়।

 

ধাতু পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ (Recycling of Metals)
পৃথিবীতে প্রতিটি মৌলিক পদার্থ বা ধাতুর পরিমাণ নির্দিষ্ট। কোনো ধাতুর তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের পর সেটা ফেলে না দিয়ে সেটাকে সংগ্রহ করে ঐ ধাতু তৈরির কারখানায় সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঐ পরিত্যক্ত ধাতু থেকে ব্যবহার উপযোগী ধাতু তৈরি করা হয়। পরিত্যক্ত ধাতু থেকে আবার ব্যবহার উপযোগী ধাতুতে পরিণত করার পদ্ধতিকে ধাতু পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বলে। যেমন—পরিত্যক্ত আলুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিলকে অ্যালুমিনিয়াম তৈরির কারখানায় প্রেরণ করে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। পরিত্যক্ত লোহাকে লোহা তৈরির কারখানায় প্রেরণ করে লোহা ধাতু পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। আমেরিকায় যে কপার ব্যবহৃত হয় সেই কপারের প্রায় 21% কপার পুনঃপ্রক্রিয়াজাত এর মাধ্যমে তৈরি করে। ইউরোপে যে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহৃত হয় সেই অ্যালুমিনিয়ামের 60% অ্যালুমিনিয়াম পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি হয়।

Content added By

খনি থেকে যে অধাতুসমূহকে পাওয়া যায় তাদেরকে খনিজ অধাতু বলা হয়। সালফার একটি খনিজ অধাতু এবং খনি থেকে সালফার সংগ্রহ করা হয়।
 

সালফার
সালফার হলুদ বর্ণের পদার্থ। সালফারের খনি মাটির অনেক নিচে থাকে। ফ্রাশ (Frasch) পদ্ধতিতে সালফারের খনি থেকে সালফারকে নিষ্কাশন করা হয়। এক্ষেত্রে মাটির অনেক নিচে সালফারের খনির মধ্যে তিনটি এককেন্দ্রিক পাইপ প্রবেশ করানো হয়, যাকে ফ্লাশ পাইপ বলে। সালফার 115° C তাপমাত্রার গলে যায়। এজন্য সালফারের গলনাঙ্কের চেয়ে বেশি তাপমাত্রার গরম পানি (সুপার হিটেড ওয়াটার) তিনটি এককেন্দ্রিক নলের বাইরের পাইপ দিয়ে প্রবাহিত করা হয় যাতে পরম পানির তাপমাত্রার সালফার পলে যায়। আমরা জানি এক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে পানির স্ফুটনাঙ্ক 100° C. কিন্তু চাপ বাড়ালে পানির স্ফুটনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। এভাবে অতিরিক্ত চাপে 100° C থেকে 374°C তাপমাত্রার মধ্যবর্তী যেকোনো তাপমাত্রার পানিকে সুপার হিটেড ওয়াটার বলে। এবার সবচেয়ে ভিতরের পাইপ দিয়ে 20-22 বায়ুমণ্ডল চাপের বাতাস প্রবাহিত করা হয়। একদিকে বাইরের পাইপ দিয়ে পরম পানির চাপে এবং সবচেয়ে ভিতরের পাইপ দিয়ে বাতাসের চাপে গলিত সালফার মাঝের পাইপ দিয়ে মাটির উপরে উঠে এসে বাইরের পাত্রে জমা হয়।
 

সালফারের ব্যবহার
সালফার বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। যেমন—

(i) সালফিউরিক এসিড প্রস্তুতিতে সালফার ব্যবহার করা হয়। 

(ii) রাবারকে টেকসই করার জন্য রাবারের মধ্যে সালফার যোগ করা হয়। একে রাবারের ভলকানাইজিং বলে। 

(iii) সালফানাইড দ্বারা বিভিন্ন প্রকার ওষুধ তৈরি করা হয়। সালফানাইড ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস ব্যবহার করা করে।
 

সালফানাইড প্রস্তুতিতে সালফার ব্যবহার করা হয়। 

 

সালফারের যৌগ
সালফারের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ যৌগ নিচে আলোচনা করা হলো
 

সালফার ডাই-অক্সাইড
সালফারকে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সালফার ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে৷
                  S + O 2            SO₂
 

সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস অত্যন্ত বিষায়। এই গ্যাস নাক বা মুখের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের ক্ষতি হয়। SO2 গ্যাস চোখে প্রবেশ করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে। কয়লার মধ্যে যদি সালফার থাকে বা পেট্রোলিয়াম তেলের মধ্যে যদি সালফার থাকে তবে কয়লা বা তেলকে বাতাসে পোড়ালে কয়লা বা তেলের মধ্যের সালফার অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে তীব্র ঝাঁজালো SO: প্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। যখন বৃষ্টি হয় তখন এই গ্যাস পানির সাথে বিক্রিয়া করে সালফিউরাস এসিড (H2SO3) উৎপন্ন করে যেটি বৃষ্টির পানির সাথে মাটিতে পড়ে। এই বৃষ্টিকে এসিড বৃষ্টি বলে।
 

 SO₂ + H₂O             H₂SO3
 

সালফিউরিক এসিড
সালফিউরিক এসিড অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য অপেক্ষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় বলে সালফিউরিক এসিডকে রাসায়নিক দ্রব্যের রাজা বলা হয়। শিল্পকারখানার কঠিন সালফার থেকে সালফিউরিক এসিডকে প্রস্তুত করা হয়। এই পদ্ধতিকে স্পর্শ পদ্ধতি বলে। স্পর্শ পদ্ধতি: স্পর্শ পদ্ধতিটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।

 

ধাপ 1: প্রথমে একটি চুল্লিতে সালফার (S) এবং শুষ্ক বায়ু (যে বায়ুতে জলীয় বাষ্প নেই) প্রবাহিত করা হয়। এই চুল্লিতে সালফার এবং অক্সিজেন বিক্রিয়া করে সালফার ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে। 

S + O 2          SO2

ধাপ 2:  SO2 গ্যাসের সাথে কিছু O2 গ্যাস একটি চুল্লিতে প্রেরণ করা হয়। এই চুল্লির তাপমাত্রা থাকে 450°C – 550°C এবং প্রভাবক থাকে ভ্যানাডিয়াম পেন্টা-অক্সাইড। এই চুল্লিতে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রভাবকের উপস্থিতিতে SO2 এবং O2 বিক্রিয়া করে সালফার ট্রাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে।
 

2SO2 + O2     → 2SO3

ধাপ 3: উৎপন্ন SO3 এর সাথে H2O এর সংস্পর্শ ঘটলে H2SO4 তৈরি হবে। কিন্তু SO3 এর সাথে সরাসরি H2O বিক্রিয়ায় বাষ্পীয় H2SO, তৈরি হয় যা ঘন কুয়াশার মতো অবস্থা তৈরি করে। এতে শিল্পকারখানায় কাজের অসুবিধা হয়। এছাড়া এই বাষ্পীয় H2SO4 কে ঘনীভূত করে তরল H2SO4 এ পরিণত করা কঠিন। এজন্য SO3 কে প্রথমে গাঢ় H2SO4 এর মধ্যে শোষণ করিয়ে ধূমায়মান সালফিউরিক এসিড তৈরি করা হয়। (ধূমায়মান সালফিউরিক এসিডকে অলিয়াম বলে। এর সংকেত H2S2O7)
 

H2SO4 + SO3            H2S207

 

ধূমায়মান সালফিউরিক এসিড এর সাথে পানির বিক্রিয়া ঘটিয়ে তরল সালফিউরিক এসিড তৈরি করা হয়। 

H2S2O7 + H2O                       2H2SO4

 

সালফিউরিক এসিডের ধর্ম
 

এসিড ধর্ম: লঘু H2SO4 বা গাঢ় H2SO4 কোনো ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে লবণ এবং পানি তৈরি করে। একে H2SO4 এর এসিড ধর্ম বলে। যেমন: সালফিউরিক এসিড ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড এর সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম সালফেট লবণ এবং পানি উৎপন্ন করে।

জারণ ধর্ম (Oxidation Property ) 

H2SO4 এর মধ্যে অনেক বেশি পানি থাকলে অর্থাৎ পানির মধ্যে H2SO4 দিলে সেই H2SO4 কে লঘু H2SO4 এসিড বলে। লঘু H2SO4 এর জারণ ধর্ম নেই। কিন্তু যে H2SO4 এর মধ্যে পানি কম পরিমাণে থাকে সেই H2SO4 গাঢ় H2SO4 বলে। গাঢ় H2SO এর জারণ ধর্ম আছে। গাঢ় H2SO4 কপারকে জারিত করে কপার সালফেটে পরিণত করে এবং নিজে বিজারিত হয়ে সালফার ডাই- অক্সাইড এবং পানি উৎপন্ন করে।

2H2SO4 (গাঢ়) + Cu              CuSO4 + SO2 + 2H2O
 

নিরুদন ধর্ম  (The Dehydrating Property) 

যে পদার্থ কোনো যৌগ থেকে পানি শোষণ করে সেই পদার্থকে নিরুদক বলে। পানি শোষণ করার ধর্মকে নিরুদন ধর্ম বলে। লঘু H2SO4 এর কোনো নিরুদন ধর্ম নেই, কিন্তু গাঢ় H2SO4 এর নিরুদন ধর্ম আছে। গাঢ় H2SO4 চিনি (C12H22O11) থেকে পানি শোষণ করে। এজন্য গাঢ় H2 SO4 কে নিরুদক বলে।
 

C12H22O11 + H2SO4                12C + H2SO4.11H₂O

Content added By
Promotion